By   S M Arif Hossain
Sun, 01-Sep-2019, 17:53

মেমসাহেব। নিমাই ভট্টাচার্য। ১৪,মেমসাহেবের দিল্লীবাস। মেমসাহেবের দিল্লীবাসের প্রতিটি মুহুর্তের কাহিনী জানিবার জন্য তুমি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে উঠেছ। মেমসাহেব কি বলল, কি করল, কেমন করে আদর করল, কোথায় কোথায় ঘুরল ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার রকমের প্রশ্ন তোমার মনে উদয় হচ্ছে। তাই না? হবেই তো। শুধু তুমি নও, সবারই হবে। আমি সবকিছুই তোমাকে জানাব। তবে প্রতিটি মুহুর্তের কাহিনী লেখা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যে, ইচ্ছা থাকলেও সবকিছু লেখা যায় না। তোমাকে কিছুটা অনুমান করে নিতে হবে। তাছাড়া মানুষের জীবনের ঐ বিচিত্ৰ অধ্যায়ের সবকিছু কি ভাষা দিয়ে লেখা যায়? বেলা এগারটার সময় ব্রেকফাস্ট খেয়ে দুঘণ্টা ধরে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে দুজনে কত কি করেছিলাম। কখনও ও আমাকে কাছে টেনেছে, কখনও বা আমি ওকে টেনে নিয়েছি আমার বুকের মধ্যে। কখনও আমি ওর ওষ্ঠে বিষ ঢেলেছি, কখনও বা আমার ওষ্ঠে ও ভালবাসা ঢেলেছে। কখনও আবার দু’জনে দুজনকে দেখেছি প্রাণভরে। সে-দেখা যেন শুভদৃষ্টির চাইতেও অনেক মিষ্টি, অনেক স্মরণীয় হয়েছিল। আমি বললাম, কতদিন বাদে তোমাকে দেখলাম। সারাজীবন ধরে দেখলেও আমার সে-লোকসান পূরণ হবে না। আমার বুকের ’পর মাথা রেখে শুয়ে শুয়েই ও একটু হেসে শুধু বললে, তাই বুঝি? তবে কি? বন-হরিণীর মত মুহুর্তের মধ্যে মেমসাহেবের চোখের দৃষ্টিটা একটা ঘুরপাক দিয়ে আকাশের কোলে ভেসে বেড়াল কিছুক্ষণ। একটু পরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি কিন্তু তোমাকে রোজ দেখতে পেতাম। আমি চমকে উঠলাম, তার মানে? ও একটু হাসল। দু’হাত দিয়ে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে প্ৰায় মুখের পর মুখ দিয়ে বললো, সত্যি তোমাকে রোজ দেখেছি। এবার আর চমকে উঠিনি। হাসলাম। বললাম, কেন আজে বাজে বকছ? অ্যাজে-বাজে নয় গো আজে-বাজে নয়। রোজ সকালে কলেজে বেরুবার পথে রাসবিহারীর মোড়ে এলেই মনে হতো তুমি দাঁড়িয়ে আছ, ইশারায় ডাকছি। তারপর আমরা চলেছি। এসপ্ল্যানেড, ডালহৌসী, হাওড়া। এবার মেমসাহেব উবুড় হয়ে শুয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার মুখের পর। বিকেলবেলায় ফেরার পথে তোমাকে যেন আরো বেশী স্পষ্ট করে দেখতে পেতাম। মনে হতো তুমি রাইটার্স বিল্ডিংএর ডিউটি শেষ করে কোনদিন ডালহৌসী স্কোয়ারের ঐ কোণায়, কোনদিন লাটসাহেবের বাড়ির ওপাশে দাঁড়িয়ে আর। এবার যেন হঠাৎ মেমসাহেব কেঁদে ফেলল। ওগো, বিশ্বাস কর, কলেজ থেকে ফেরবার পর বিকেল-সন্ধ্যা যেন আর কাটতে চাইত না?– আমি চট করে মন্তব্য করলাম, রাত্রিটা বুঝি মহাশান্তিতে কাটাতে? হঠাৎ যেন লজ্জায় ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমার মুখের পাশে মুখটা লুকাল। আমি জানতে চাইলাম, কি হলো? মুখ তুলল না। মুখ গুঁজে রেখেই ফিসফিস করে বললো, কিছু বলব না। কেন। তোমার ডাঁট বেড়ে যাবে। ঠিক আছে। আমার কাছ থেকেও তুমি কিছু জানতে পারে না। তাছাড়া তোমার প্রাণের বন্ধু জয়া কি করেছিল, কি বলেছিল, সেসব কিছু তোমাকে বলব না। মেমসাহেব। আর স্থির থাকতে পারে না। উঠে বসল। আমার হাতদু’টো ধরে বললো, ওগো, বল না, কি হয়েছিল। আমি মাথা নেড়ে গাইলাম, কিছু বলব বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে। প্ৰথমে খুব বীরত্ব দেখিয়ে মেমসাহেব গাইল, আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে—তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, খুব ভাল কথা। অত যখন বীরত্ব, তখন জয়ার কথা শুনে কি হবে? আমার সোল প্রোপাইটার-কাম-ম্যানেজিং ডাইরেকটির ঘাবড়ে গেল। বোধহয় ভাবল, জয়া এই উঠতি বাজারে শেয়ার কিনে ভবিষ্যতে বেশ কিছু মুনাফা লুঠতে চায়। হয়ত আরো শেয়ার কিনে শেষপর্যন্ত অংশীদার থেকে– ও প্ৰায় আমার বুকের পর লুটিয়ে পড়ল। বল না গো, জয়া কি করেছে? এক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে আবার বললো, জয়া আমার বন্ধু হলে কি হয়! আমি জানি ও সুবিধের মেয়ে নয়, ও সবকিছু করতে পারে। জান দোলাবৌদি, জয়া আমাকে কিছুই করে নি। তবে ও একটু বেশী স্মার্ট, বেশী মডার্ন। তাছাড়া বড়লোকের আদুরে মেয়ে বলে বেশ ঢলঢল ভাব আছে। আমার মত ছোকরাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসলে জয়ার কোন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। হাসতে হাসতে হয়ত দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল, হয়ত কাঁধে মাথা রেখেই হিঃ হিঃ করতে লাগল। মেমসাহেব এসব জানে। একবার আমি, মেমসাহেব। আর জয়া ব্যারাকপুর গান্ধীঘাট বেড়াতে গিয়ে কি কাণ্ডটাই না হলো! হি-হি হা-হা করে হাসতে হাসতে জয়ার বুকের কাপড়টা পাশে পড়ে গিয়েছিল। মেমসাহেব হু একবার ওকে ইশারা করলেও ও কিছু গ্ৰাহ্য করল না। রাগে গজগজ করছিল মেমসাহেব কিন্তু কিছু বলতে পারল না। আমি অবস্থা বুঝে চট করে উঠে একটু পায়চারি করতে করতে জয়ার পিছন দিকে চলে গেলাম। তারপর দেখি মেমসাহেব জয়ার আঁচল ঠিক করে দিল। কলকাতা ফিরে মেমসাহেব আমাকে বলেছিল, এমন অসভ্য মেয়ে আর দেখিনি। দিল্লীতে জয়ার ছোটকাকা হোম মিনিস্ট্রিতে ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন। তাইতো মাঝে মাঝেই দিল্লী বেড়াতে আসত। মেমসাহেব হয়ত ভাবল না জানি ওর অনুপস্থিতিতে জয়া আরো কি করছে। জয়ারা এর মধ্যে দুবার দিল্লী এলেও আমার সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল। তাও বেশীক্ষণের জন্য নয়। আর সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে জয়া আমার পবিত্ৰতা নষ্ট করবার কোন চেষ্টাও করে নি। শুধু শুধু মেমসাহেবকে ঘাবড়ে দেবার জন্য জয়ার কথা বললাম। রিপোর্টার হলেও হঠাৎ পলিটিসিয়ান হয়ে মেমসাহেবের সঙ্গে একটু পলিটিকস করলাম। কাজ হলো। শর্ত হলো মেমসাহেব আগে সবকিছু বলবে, পরে আমি জয়ার কথা বলব। বেল বাজিয়ে গজাননকে তলব করে হুকুম দিলাম, হাফ-সেট চায় লেআও। গজানন মেমসাহেবের কাছে আৰ্জি জানাল, বিবিজি, ছোটসাবক চায় পিনা থোড়ি কমতি হোন চাইয়ে। মেমসাহেব একবার আমাকে দেখে নিয়ে গজাননকে বললে, তোমার ছোটসাব আমার কিছু কথা শোনে না। ওর কথা শুনে স্নেহাতুর বৃদ্ধ গজাননও হেসে ফেলল। এ-কথা ঠিক না বিবিজি ছোটসাব চব্বিশ ঘণ্টা শুধু তোমার কথাই বলে। গজানন, তুমিও তোমার ছোটোসাব-এর পাল্লায় পড়ে মিথ্যা कथां दळ। গজানন জিভ কেটে বললো, ভগবান কা কসম বিবিজি, বুট আমি কক্ষনো বলব না। মেমসাহেব হাসল, আমি হাসলাম। গজানন বললো, যদি তোমার গুসসা না হয়, তাহলে তোমাকে একটা কথা বলতাম। মেমসাহেব বললো, তোমার কথায় আমি কেন রাগ করব? ছোটোসাব তোমাকে ভীষণ প্যার করে। কি করে বুঝলে? মেমসাহেব জেরা করে। গজানন হাসল। বললো, বিবিজি, আমি তোমাদের আংরেজি পড়িনি। তোমাদের মত আমার দিমাগি নেই। এই দিল্লীতে প্ৰায় পয়ত্ৰিশ বছর হয়ে গেল। অনেক বড় বড় লোক দেখলাম কিন্তু হামারা ছোটাসাব-এর মত লোক খুব বেশী হয় না। আমি গজাননকে একটা দাবিড় দিয়ে বলি, যা, ভাগ। চা নিয়ে আয়। গজানন চা আনল। চলে যাবার সময় আমি বললাম, গজানন, কিছু টাকা রেখে যেও। গজানন চোখ দিয়ে মেমসাহেবকে ইশারা করে বললো, হাগো বিবিজি, টাকা দেব নাকি? আমি উঠে গজাননকে একটা থাপ্পড় মারতে গেলেই ও দৌড় দিল। চা খেতে খেতে মেমসাহেব কি বলল জান? বলল অনেক কিছু। একদিন সকালে উঠে মেজদি ওকে বলল, আমি আর পারছি না। মেমসাহেব জানতে চাইল, কি পারছিস না রে? প্রকসি দিতে। কিসের প্রকসি? কার প্রকৃসি? কার আবার? রিপোর্টারের। মেমসাহেব বলল, অসভ্যতা করবি না মেজদি। মনে মনে কিন্তু সত্যি একটু চিন্তিত হলো। একটু পরে একটু ফাঁকা পেয়ে মেমসাহেব মেজদিকে ধরল। হ্যারে কি হয়েছে রে? মেজদি দর কষাকষি করে, যা চাইব তাই দিবি বল। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একটু ভিজিয়ে নিল মেমসাহেব। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা একটু কামড়ে ভ্রূ কুঁচকে এক মুহুর্তের জন্য ভেবে নিল। ঠিক আছে যা চাইবি তাই দেবে। মেজদি ওস্তাদ মেয়ে। কাঁচা কাজ করবার পাত্রী সে নয়। তাই গ্যারান্টি চাইল। মা কালীর ফটো ছুঁয়ে প্ৰতিজ্ঞা কর, আমি যা চাইব তাই দিবি। ও ঘাবড়ে যায়। একবার ভাবে মেজদি ঠকিয়ে কিছু আদায় করবে। আবার ভাবে, না, না, কিছু দিয়েও খবরটা জানা দরকার। মেমসাহেবের দোটানা মন শেষপৰ্যন্ত মেজদির ফাঁদে আটকে যায়। মা কালীর ফটো ছুয়েই প্ৰতিজ্ঞা করল, আমাকে সবকিছু খুলে বললে তুই যা চাইবি, তাই দেব। মেজদি ওকে টানতে টানতে ঐ কোণার ছোট্ট বসবার ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। মেমসাহেবের বুকটা চিপটিপ করে। গোল টেবিলের পাশ থেকে দু’টো চেয়ার টেনে দুজনে পাশাপাশি বসল। মেজদি শুরু করল, রাত্তিরে তুই কি করিস, কি বকবক কারিস, তা জানিস? কি করি রে মেজদি? কি আর করবি? আমাকে রিপোর্টার ভেবে কত আদর করিস, তা জানিস? লজ্জায় আমার কালে মেমসাহেবের মুখও লাল হয়েছিল। বলেছিল, যা যা, বাজে বকিস না। মেজদি সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ঠিক আছে। না শুনতে চাস, ভাল কথা। ও তাড়াতাড়ি মেজদির হাত ধরে বসিয়ে দেয়, আচ্ছ যা বলবি বল। তোর আদরের চোটে তো আমার প্রাণ বেরুবার দায় হয়।… কেন মিথ্যে কথা বলছিস? মেজদি মুচকি হাসতে হাসতে বললো, মা কালীর ফটো ছুঁয়ে বলব? না, না, আর মা কালীর ফটো ছুঁয়ে বলতে হবে না। শুধু কি আদর? কত কথা বলিস! ঘুমিয়ে? ঘুমিয়ে? মেজদি মুচকি হেসে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞাসা কর। মা শুনেছে? মেমসাহেব চমকে ওঠে। একদিন তো ডেফিনিট শুনেছে, হয়ত রোজই শোনে। ও তাড়াতাড়ি মেজদির হাতটা চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কি কথা বলেছি রে? নির্লিপ্তভাবে মেজদি উত্তর দিল তুই ওকে যা যা বলে আদর করিস, তাই বলেছিস। আবার কি বলবি? সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে আমরা গল্প করছিলাম। মেমসাহেব ডান হাত দিয়ে আমার মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, দেখেছ, ঘুমিয়েও তোমাকে ভুলতে পারি না। একটু চুপ করে এবার ফিসফিস করে বলল, দেখেছ, তোমাকে কত ভালবাসি। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে এক গাল ধুয়া ছেড়ে বললাম, ঘোড়ার ডিম তালবাস। যদি সত্যি সত্যিই ভালবাসতে, তাহলে আজও মেজদি তোমার পাশে শোবার সাহস পায়? মেমসাহেব আমাকে ভেংচি কেটে বলল, শুতে দিচ্ছি। আর कि! এবার আমি ওর কানে কানে বললাম, আজ তো আমার হাতে লাটাই। আজ কোথায় উড়ে যাবে? তাছাড়া আজ তো তুমি আমাকে পুরস্কার দেবে। পুরস্কার? সেই যে-যা চাইবে, তাই পাবে-পুরস্কার। মেমসাহেব আমার পাশ থেকে প্ৰায় দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি আজই কলকাতা পালাচ্ছি। নাটকের এই এক চরম গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে আবার গজাননের আবির্ভাব হলো। বেশ মেজাজের সঙ্গে বলল, দু’টো বেজে গেছে। তোমরা কি সারাদিনই গল্প-গুজব করবে? খাওয়া-দাওয়া করবে না? দু’টো বেজে গেছে? দুজনেই এক সঙ্গে ঘড়ি দেখে ভীষণ লজ্জিত বোধ করলাম। গজাননকে বললাম, লাঞ্চ নিয়ে এস। দশ মিনিটে আমরা স্নান করে নিচ্ছি। দিল্লীতে আমাদের দ্বৈত জীবনের উদ্বোধন সঙ্গীত কেমন লাগল? মনে হয় খারাপ লাগে নি। আমারও বেশ লেগেছিল। অনেক দুঃখ কষ্ট, সংগ্রামের পর এই আনন্দের অধিকার অর্জন করেছিলাম। তাইতো বড় মিষ্টি লেগেছিল। এই আনন্দের আত্মতৃপ্তির আস্বাদন। মেজদিকে ম্যানেজ করে কলেজ থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে ও আমার কাছে এসেছিল। এসেছিল অনেক কারণে, অনেক প্ৰয়োজনে। সমাজ-সংস্কারের অকটোপাশ থেকে মুক্ত করে একটু মিশতে চেয়েছিলাম। আমরা দুজনেই। মেমসাহেবের দিল্লী আসার কারণ ছিল সেই মুক্তির স্বাদ, আনন্দ উপভোগ করা। আরো অনেক কারণ ছিল। শূন্যতার মধ্যে দুজনেই অনেক দিন ভেসে বেড়িয়েছিলাম। দুজনেরই মন চাইছিল একটু নিরাপদ আশ্রয়। সেই আশ্রয়, সেই সংসার বাঁধার জন্য অনেক কথা বলবার ছিল। দুজনেরই মনে মনে অনেক কল্পনা আর পরিকল্পনা ছিল। সেসব সম্পর্কেও কথাবার্তা বলে একটা পাকা সিদ্ধান্ত নেবার সময় হয়েছিল। যাই হোক এক সপ্তাহ কোন কাজকর্ম করব না বলে আমিও ছুটি নিয়েছিলাম। প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম মেমসাহেবকে ট্রেনে চড়িয়ে না দেওয়া পৰ্যন্ত টাইপরাইটার আর পার্লামেণ্ট হাউস স্পৰ্শ করব না। চেয়েছিলাম প্রতিটি মুহুর্ত মেমসাহেবের সান্নিধ্য উপভোগ করব। সত্যি বলছি দোলাবৌদি, একটি মুহুৰ্তও নষ্ট করিনি। ভগবান আমাদের বিধি-নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ জানতেন বলে একটি মুহুৰ্তও অপব্যয় করতে দেননি। কথায়, গল্পে, গানে, হাসিতে ভরিয়ে তুলেছিলাম ঐ ক’টি দিন। লাঞ্চ খেতে খেতে অনেক বেলা হয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টা ট্রেন জানি করে নামবার পর থেকে মেমসাহেব একটুও বিশ্রাম করতে পারে নি। আমি বললাম, মেমসাহেব, তুমি একটু বিশ্রাম কর, একটু ঘুমিয়ে নাও। এই ক’মাসে কলকাতায় অনেক ঘুমিয়েছি, অনেক বিশ্রাম করেছি। তুমি আর আমাকে ঘুমুতে বল না। এক মিনিট পরেই বলল, তার চাইতে তুমি বরং একটু খোও। আমি তোমার গায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আমি কেন শোব? শোও না। আমি তোমার পাশে বসে বসে গল্প করব। শোবার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু লোভ সামলাতে পারলাম না। দিল্লীর কাব্যহীন জীবনে অনেকদিন এমনি একটি পরম দিনের স্বপ্ন দেখেছি। মেমসাহেব বিশ্রাম করল না। কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই শুয়ে পড়লাম। ও আমার পাশে বসে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গুনগুন করে গান গাইছিল। কখনও কখনও আবার একটু আদর করছিল। কি আশ্চৰ্য আনন্দে যে আমার সারা মন ভরে গিয়েছিল, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। স্বপ্ন যে এমন করে বাস্তবে দেখা দিতে পারে, তা ভেবে আমি অদ্ভুত সাফল্য, সার্থকতার স্বাদ উপভোগ করলাম। বালিশ দু’টোকে ডিভোর্স করে মেমসাহেবের কোলে মাথা রেখে দু’হাত দিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলাম। ও জিজ্ঞাসা করল, ঘুম পাচ্ছে? কথা বললাম না, শুধু মাথা নেড়ে জানালাম, না। ক্লান্ত লাগছে? তবে? স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন? মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, স্বপ্ন দেখছি। মুখটা আমার মুখের কাছে এনে ও জানতে চাইল, কি স্বপ্ন দেখছি? তোমাকে স্বপ্ন দেখছি। আমাকে? হ্যাঁ, তোমাকে। আমি তো তোমার পাশেই রয়েছি। আমাকে আবার কি স্বপ্ন দেখছি? ওর কোলের পর মাথা রেখেই চিৎ হয়ে শুলাম। দু’হাত দিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে বললাম, হ্যাঁ, তোমাকেই স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন দেখছি, জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমি এমনি করে তোমার কোলে নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাচ্ছি, ভালবাসা পাচ্ছি, ভরসা পাচ্ছি। মুহুর্তের জন্য গর্বের বিদ্যুৎ চমকে উঠে মেমসাহেবের সারা মুখটা উজ্জল করে তুললে। পরের মুহুর্তেই ওর ঘন কালো গভীর উজ্জল দু’টো চোখ কোথায় যেন তলিয়ে গেল। আমাকে বলল, ওগো, তুমি আমাকে অমন করে চাইবে না, তুমি আমাকে এত ভালবাসবে না। কোন বল তো? যদি কোনদিন কোন কিছু দুর্ঘটনা ঘটে, যদি কোনদিন আমি তোমার আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে চলতে না পারি, সেদিন তুমি সে দুঃখ, সে আঘাত সহ্য করতে পারবে না। আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, তা হতে পারে না মেমসাহেব। আমার স্বপ্ন ভেঙে দেবার সাহস তোমারও নেই, ভগবানেরও নেই। আমার কথা শুনে বোধহয় ওর একটু গৰ্ব হলো। বলল, আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া তোমার জীবন কল্পনা করতে পার না। কিন্তু তাই বলে অমন করে বলে না। কেন বলব না। মেমসাহেব? তোমার মনে কি আজো কোন সন্দেহ আছে? সন্দেহ থাকলে কেউ এমন করে ছুটে আসে! মেমসাহেব। আবার থামে। আবার বলল, তোমার দিক থেকে যে আমি কোন আঘাত পাব না, তা আমি জানি। ভয় হয় নিজেকে নিয়েই। আমি কি পারব তোমার আশা পূর্ণ করতে? পারব কি সুখী করতে? তুমি না পারলে আর কেউ তো পারবে না। মেমসাহেব। তুমি না পারলে স্বয়ং ভগবানও আমাকে সুখী কয়তে পারবেন না। আরো কত কথা হলো। কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে যায়, বিকেল ঘুরে সন্ধ্যা হলো। ঘর-বাড়ি রাস্তাঘাটে আলো জ্বলে উঠল। মেমসাহেব বলল, ছাড়। আলোটা জেলে দিই। না, না, আলো জেলে না। এই অন্ধকারেই তোমাকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আলো জ্বালালেই আরো অনেক কিছু দেখতে হবে। পাগল কোথাকার। এমন পাগল আর পাবে না। ও আমাকে চেপে জড়িয়ে ধরে বলল, এমন পাগলীও আর পাবে না। ভগবান অনেক হিসাব করেই পাগলার কপালে পাগলী জুটিয়েছেন। তা না হলে, কি এত মিল, এত ভালবাসা হয়? ঐ অন্ধকারের মধ্যেই আরো কিছু সময় কেটে গেল। মেমসাহেব বলল, চলো, একটু ঘুরে আসি। তোমার কি বেড়াতে ইচ্ছা করছে? কলকাতায় তো কোনদিন শান্তিতে বেড়াতে পারিনি। এখানে অন্ততঃ কোন দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুরতে হবে না। মেমসাহেব আলো জ্বালল। বেল টিপে বেয়ারা ডাকল। চা আনাল। চা তৈরী করল। আমি শুয়ে শুয়েই এক কাপ চা খেলাম। এবার মেমসাহেব তাড়া দেয়, নাও, চটপট তৈরী হয়ে নাও। আমি শুয়ে শুয়েই বললাম, ওয়াড্রবটা খোল। আমাকে একটা প্যাণ্ট আর বুশশার্ট দাও। মেমসাহেব লম্বা বেণী দুলিয়ে বেশ হেলেন্দুলে এগিয়ে গিয়ে ওয়াড়ব খুলেই প্ৰায় চীৎকার করে উঠল, একি তোমার ওয়াড্রবে শাড়ি। একবার শাড়িগুলো নেড়ে বলল, এ যে অনেক রকমের শাড়ি। ঘুরে ঘুরে কালেকশন করেছ বুঝি? ও আমার প্যাণ্ট-বুশ-শার্ট না দিয়ে হাঙ্গার থেকে একটা কটুকি শাড়ি এনে আমার কাছে আব্দার করল, আমি এই শাড়িটা পরব? তবে কি আমি পরব? শাড়িটার দু-একটা ভাজ খুলে একটু জড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, লাভলি! কি লাভলি? শাড়ি না আমি? শাড়িটা গায়ে জড়িয়েই আয়নার সামনে একটু ঘুরে গোল মেমসাহেব। বলল, ইউ আর নটেরিয়াস বাট শাড়ি ইজ লাভলি। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে মেমসাহেবকে জড়িয়ে ধরতেই ও বকে উঠল, সব সময় জড়াবে না। শাড়িটার ভাঁজ নষ্ট করো না। চট করে ও এবার আমার দিকে ঘুরে আমার মুখের দিকে ব্যাকুল হয়ে চেয়ে বলল, ওগো ব্লাউজের কি হবে? তুমি নিশ্চয়ই ব্লাউজ পিস কেননি? আমি ওর কানটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরের কোণায় নিয়ে গিয়ে একটা ছোট সুটকেস খুলে দিলাম। নটি গার্ল! হ্যাভ এ লুক। হাসতে হাসতে বলল, ব্লাউজ তৈরী করিয়েছ? আজ্ঞে হ্যাঁ। মাপ পেলে কোথায়? তোমার ব্লাউজের মাপ আমি জানি না? আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে। কানে কানে বলি, সুড আই টল ইউ ইউর ভাইট্যাল স্ট্যাটিকটিস? মেমসাহেব আমার পাশ থেকে পালিয়ে যেতে যেতে বলল, কেবল অসত্যতা। জার্নালিস্টগুলো বড় অসভ্য হয়, তাই না? তোমাদের মত ইয়ং আনম্যারেড প্রফেসারগুলো বড় ধার্মিক হয়, তাই না? কি করব? তোমাদের মত এক-একটা দস্যু-ডাকাতের হাতে পড়লে আমাদের কি নিস্তার আছে? আমি যেন আরো কি বলতে গিয়েছিলাম, ও বাধা দিয়ে বলল, এবার তর্ক বন্ধ করে বেরুবে কি? মেমসাহেব শাড়িটা সোফার পর রেখে নিজের সুটকেস থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি বের করে বলল, এই নাও পর। এবারও জড়িপাড় ধুতি দিলে না? জড়িপাড় ধুতি না পাবার জন্য তোমার কি কিছু অসুবিধা বা ক্ষতি হচ্ছে? দোলাবৌদি, আমার জীবনের সেসব স্মরণীয় দিনের কথা স্মৃতিতে অমর অক্ষয় হয়ে আছে। আজ আমি রিক্ত, নিঃস্ব। ভিখারী। আজ আমার বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে অহরহ রাবণের চিতা জ্বলিছে। গঙ্গা-যমুনা নর্মদা-গোদাবরীর সমস্ত জল দিয়েও এ আগুন নিভবে না, নেভাতে পারে না। বাইরে থেকে আমার চাকচিক্য দেখে, আমার পার্থিব সাফল্য দেখে, আমার মুখের হাসি দেখে সবাই আমাকে কত সুখী ভাবে। কত মানুষ আরো কত কি ভাবে। আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কতজনের কত বিচিত্র ধারণা! মনে মনে আমার হাসি পায়। একবার যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম, যদি তারস্বরে চিৎকার করে সব কিছু বলতে পারতাম, যদি হনুমানের মত বুক চিরে আমার অন্তরটা সবাইকে দেখাতে পারতাম। তবে হয়ত– দেখেছ, আবার কি আজে-বাজে বকতে শুরু করেছি? তোমাকে তো আগেই লিখেছি ঐ পোড়া কপালীর কথা লিখতে গেলে, ভাবতে গেলে, মাঝে মাঝেই আমার মাথাটা কেমন করে। উঠে। আরো একটু ধৈৰ্য ধরা। তুমি হয়ত বুঝবে আমার মনের অবস্থা। দোলাবৌদি আমাদের দুজনের কাহিনী নিয়ে ভলিউম ভলিউম বই লেখা যায়। সেই সাত দিনের দিল্লী বাসের কাহিনী নিয়েই হয়ত একটা চমৎকার উপন্যাস লেখা হতে পারে। তাছাড়া তিন দিনের জন্য জয়পুর আর সিলিসের ঘোরা? আহাহা! সেই তিনটি দিন যদি তিনটি বছর হতো। যদি সেই তিনটি দিন কোন দিনই ফুরাত না। দিল্লীতে সেই প্ৰথম রাত্ৰিতে আমরা এক মিনিটের জন্যও ঘুমুলাম না। সারা রাত্ৰি কথা বলেও ভোরবেলায় মনে হয়েছিল যেন কিছুই বলা হলো না? মনে হয়েছিল যেন বিধাতাপুরুষের রসিকতায় রাত্রিটা হঠাৎ ছোট হয়েছিল। সকালবেলায় সূৰ্যকে অসহ্য মনে হয়েছিল। মোটা পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি চুরি করে আমাদের ঘরে ঢুকে বেশ উৎপাত শুরু করেছিল। কিন্তু তবুও ও আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে ছিল আর গুনগুন করে গাইছিল, আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো… আমি প্রশ্ন করলাম, সত্যি? ও বলল, তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো। তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও– আমি আবার কোথায় যাব? মেমসাহেব মাথা নেড়ে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার গাইতে থাকে, আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো। সিওর? সিওর। ও এবার কনুই-এর ভর দিয়ে ডান হাতে মাথাটা রেখে বাঁ হাত দিয়ে আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গাইল– আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস– দীর্ঘ দিসব, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস। যদি আর-কারে ভালবাস… আমি বললাম, তুমি পারমিশন দেবে? মেমসাহেব হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই আবার গাইল– আর যদি ফিরে নাহি আস,। তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,। আমি যত দুঃখ পাই গো। আমি বললাম, আমি আর কিছু চাইছি না, তুমিও দুঃখ পাবে না। ও আমাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরে ঠোঁটে একটু ভালবাসা দিয়ে বলল, আমি তা জানি গো, জানি। সকালবেলায় চা খেতে খেতে মেমসাহেব বলল, ওগো, চলে না। দুদিনের জন্য জয়পুর ঘুরে আসি। আইডিয়াটা মন্দ লাগল না। ঐ চা খেতে খেতেই প্ল্যান হয়ে গেল। একদিন জয়পুর, একদিন সিলিসের ফরেস্ট বাংলোয় থাকব। তারপর দিল্লী ফিরে এসে কিছু ঘোরাঘুরি, দেখাশুনা আর সংসার পাতার বিধিব্যবস্থা করা হবে বলেও ঠিক করলাম।

View more on Facebook

SHARE VIA :

This site was designed with Websites.co.in - Website Builder

IMPORTANT NOTICE
DISCLAIMER

This website was created by a user of Websites.co.in, a free instant website builder. Websites.co.in does NOT endorse, verify, or guarantee the accuracy, safety, or legality of this site's content, products, or services. Always exercise caution—do not share sensitive data or make payments without independent verification. Report suspicious activity by clicking the report abuse below.

WhatsApp Google Map
×

Caution! Unverified Website!


The identity of this user has not yet been verified. Please make transactions at your own risk!

Enquire Now
×

Leave Your Message

If you have any questions about the products/services we provide simply use the form below.

Safety and Abuse Reporting

Thanks for being awesome!

We appreciate you contacting us. Our support will get back in touch with you soon!

Have a great day!

Are you sure you want to report abuse against this website?

Please note that your query will be processed only if we find it relevant. Rest all requests will be ignored. If you need help with the website, please login to your dashboard and connect to support

;